আমরা কে, আমরা কীভাবে আচরণ করি—
সিভিক সেন্স মানে এক কথায়—পাবলিক স্পেসে এমন আচরণ করা, যাতে অন্যের জীবন, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, আরাম কিংবা কাজের ক্ষতি না হয়। রাস্তা পার হওয়া, লাইনে দাঁড়ানো, আবর্জনা ডাস্টবিনে ফেলা, ট্রাফিক রুল মানা, শব্দ কম রাখা, সরকারি জিনিসপত্র নষ্ট না করা—এসবই সিভিক সেন্সের আওতা। নাগরিক জীবনের গুণগত মান, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য—সবকিছুর শিকড় এই সাধারণ আচরণে। নিয়ম শুধু কাগজে থাকলে হয় না; নিয়মকে প্রতিদিনের অভ্যাস বানাতে পারলে সমাজ চলে ঘড়ির কাঁটার মতো।
এখন প্রশ্ন—দক্ষিণ এশিয়ার (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল) বাস্তব ছবিটা কেমন? পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের বেশ কিছু মাপকাঠিতে আমরা এখনও চাপের মুখে। ২০২৩ সালের ডেটায় দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশে PM2.5 বায়ুদূষণ WHO’র সুপারিশের বহু গুণ বেশি—বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল, ভারতেরও চিত্র উদ্বেগজনক। এটা একদিনে হয়নি; শিল্প, কৃষি-দহন, যানবাহন, নির্মাণকাজের ধুলো, আর শহরের ঘনত্ব—সব মিলেই এই অবস্থা তৈরি হয়। কিন্তু ভালো দিকও আছে—ভারতে ইন্দোরের মতো শহরগুলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ঝাড়ুদল, ধুলো নিয়ন্ত্রণ, গণপরিবহনে পরিষ্কার জ্বালানি, আর নাগরিক সম্পৃক্ততায় জাতীয় পর্যায়ে শীর্ষে উঠে এসেছে—মানে চাইলে সম্ভব।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমাদের বড় সমস্যা “মিসম্যানেজড” প্লাস্টিক। ঢাকায় সংগৃহীত বর্জ্যের উল্লেখযোগ্য অংশই প্লাস্টিক, যার বড় ভাগ ল্যান্ডফিলে বা খোলা স্থানে যায়; বাংলাদেশে বছরে উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রায় ৭০ শতাংশ খোলা জায়গায় ফেলা বা পোড়ানো হয়—এটা নদী–খাল–সাগর ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক। দক্ষিণ এশিয়া জুড়েই ভুলভাবে বর্জ্য সামলানোর প্রবণতা উচ্চ, যা দীর্ঘমেয়াদে একেবারে অটেকসই।
ট্রাফিক সেফটিতেও চিত্র টানটান। WHO ও আঞ্চলিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়—নেপালে ২০২১ সালে সড়ক-মৃত্যুহার প্রতি ১ লাখ জনে প্রায় ২৮.২, পাকিস্তানে ১১.৯; বাংলাদেশে বিভিন্ন উৎসে ২০২৩ সালে ৫,০০০ থেকে ৭,৯০০ জনের প্রাণহানির রিপোর্ট আছে—এটা শুধু চালকের দক্ষতা নয়, হেলমেট-সিটবেল্ট ব্যবহার, পথচারীর আচরণ, সড়কপথের নকশা—সব মিলিয়ে সিভিক সেন্সের প্রশ্ন। তুলনায় ইউরোপে গড় সড়ক-মৃত্যুহার অনেক কম—নিয়মের কড়া প্রয়োগ ও নাগরিকের অভ্যাস—এই দুই জিনিসই পার্থক্য গড়ে।
এখানে পশ্চিমা দেশগুলোর একটা ছোট ছবি টানা দরকার—কারণ অনেকে বলেন, “ওদের দেশে মানুষ রাস্তায় ময়লা ফেলে না, সিটবেল্ট লাগে, লাইনে দাঁড়ায়—তাই দেশ পরিষ্কার।” হ্যাঁ, কিন্তু সেটা রাতারাতি হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৩ সালে সামনের সিটে সিটবেল্ট ব্যবহার প্রায় ৯২ শতাংশ; যুক্তরাজ্যে লিটারিংয়ে অন-দ্য-স্পট ২০০ পাউন্ড জরিমানা—আর বাস্তবেই জরিমানা করা হয়। আইন আছে, নজরদারি আছে, আর মানুষ জানে—রুল ভাঙলে খেসারত দিতে হবে।
এবার আসল কথায় আসি—সিভিক সেন্সের ঘাটতি আমাদের ওপর কীভাবে ফিরে আসে? প্রথমত, খারাপ বায়ু ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সরাসরি স্বাস্থ্যকে আঘাত করে—শিশুদের শ্বাসকষ্ট, প্রাপ্তবয়স্কদের হার্ট–লাংসের রোগ বাড়ে; চিকিৎসা খরচ বাড়ে, কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, উৎপাদনশীলতা পড়ে যায়। দ্বিতীয়ত, ট্রাফিক বিশৃঙ্খলা ও নিয়মভাঙা—দেরি, দুর্ঘটনা, ইন্স্যুরেন্স খরচ—সব মিলিয়ে অর্থনীতির লুকানো ট্যাক্স। তৃতীয়ত, যখন আমরা বাইরে যাই—স্টুডেন্ট, প্রফেশনাল বা ট্যুরিস্ট হিসেবে—আমাদের আচরণই “ব্র্যান্ড” তৈরি করে। পাবলিক প্লেসে ময়লা ফেলা, নিয়ম না মানা, জোরে কথা বলা, লাইনে কাট—এসব ছোট আচরণই স্থানীয়দের চোখে বড় ইমেজ তৈরি করে। গবেষণা বলে, সংখ্যালঘু বা অভিবাসীরা এমনিতেই স্টেরিওটাইপের চাপে থাকে; খারাপ অভিজ্ঞতা হলে মানুষ দ্রুত জেনারালাইজ করে—ব্যক্তিগত ভুলকে পুরো কমিউনিটির ওপর চাপায়। ফল কী? সন্দেহ, দূরত্ব, এবং সুযোগের দরজা—জব, হাউজিং, এমনকি সহযোগিতার সুযোগ—আস্তে আস্তে সংকুচিত হয়।
শিক্ষার সুযোগ নিয়েও ভাবুন। নোংরা ও কোলাহলপূর্ণ আশপাশ, অনিরাপদ রাস্তা, অব্যবস্থাপনা—এসবের মধ্যে বাচ্চারা মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না; স্কুল-কলেজে পৌঁছাতে সময় ও ঝামেলা—ড্রপআউট বাড়ে, ভালো ট্যালেন্ট শহর ছেড়ে যায়। আর বিশ্ববিদ্যালয়–ইন্ডাস্ট্রি—যেখানে সময়মতো আসা, কিউতে থাকা, ল্যাবে সেফটি রুল মানা—এসব “সফট স্কিল” ধরেই কাজ চলে—সেখানে সিভিক সেন্সের অভাব সরাসরি পারফরম্যান্সে ধাক্কা দেয়।
কিন্তু—এটা ফিক্স করা যায়। কীভাবে? প্রথমে মানতে হবে—এটা “ওদের” বা “সরকারের” সমস্যা নয়; এটা আমার প্রতিদিনের সিদ্ধান্ত। ধরা যাক বায়ুদূষণ: নির্মাণসাইটে ধুলো নিয়ন্ত্রণ, রাস্তা নিয়মিত ঝাড়ু ও ওয়াটার স্প্রে, বর্জ্য আলাদা করা—ইন্দোর দেখিয়েছে, শহর চাইলে পারে; নাগরিকও পারে। স্কুল–মসজিদ–মন্দির–ক্লাব—যেখানে মানুষ জড়ো হয়—সেখানেই সিভিক সেন্স শেখানো যায়: রাস্তা পার হওয়ার নিয়ম, কিউ কালচার, পাবলিক সম্পত্তির যত্ন, পরিবেশবান্ধব অভ্যাস। মিডিয়া ও ইনফ্লুয়েন্সাররা ছোট ভিডিওতে “এক মিনিটের নাগরিকতা” দেখাতে পারে—ডাস্টবিন কোথায়, বাসে ওঠা–নামার শৃঙ্খলা, হাসপাতালের নীরবতা, মাঠ–পার্ক পরিষ্কার রাখা।
আইন–প্রয়োগও দরকার, কিন্তু সেটার বার্তা হতে হবে পরিষ্কার—নিয়ম সবার জন্য সমান। ফুটপাথ দখল, হর্ন বাজানো, উল্টোপথে যাওয়া, রাস্তায় থুথু বা ময়লা ফেলা—জরিমানা হলে মানুষ শেখে। যুক্তরাজ্যে স্থানীয় কাউন্সিলগুলো নিয়মিত ফাইন দেয়—আমাদের শহরগুলোও অভ্যাসে আনতে পারে স্বচ্ছ, ক্যামেরা–ভিত্তিক, পাবলিক ড্যাশবোর্ড সহ জরিমানা–প্রয়োগ। এতে “কেউ দেখছে না”—এই ধারণাটা ভাঙে।
আরেকটা বড় জিনিস—রোল মডেলিং। ট্রাফিকে পুলিশ, স্কুলে শিক্ষক, অফিসে টিম-লিড—যারা নিয়ম মানবেন, তারা বাকিদের টোন সেট করবেন। যুক্তরাষ্ট্রে সিটবেল্ট ব্যবহার ৯০ শতাংশ ছাড়িয়েছে—কঠোর আইন, প্রচার, আর সবার একসঙ্গে মানার অভ্যাসের ফল। আমরা চাইলে মোটরবাইক হেলমেট, সিটবেল্ট, জেব্রা-ক্রসিং—এসবকে “কুল” বানাতে পারি।
বর্জ্য আলাদা করা—এটা “বড় শহরের বিলাসিতা” নয়, এটা স্বাস্থ্য–অর্থনীতির বেসিক। ঘরে ভেজা-শুকনো, প্লাস্টিক আলাদা—কমিউনিটি লেভেলে কালেকশন—ল্যান্ডফিলে চাপ কমে, রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়ায়, কাজ তৈরি হয়।
শেষ কথা—সিভিক সেন্স কোনো লেকচার নয়, এটা আমাদের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার টুল। আমরা যে শহরে থাকি, যে রাস্তায় হাঁটি, যে বাতাসে নিঃশ্বাস নেই—সবকিছুর কন্ট্রোল রুম আমাদের দৈনন্দিন অভ্যাস। বাইরে কেউ আমাদের “ঘৃণা” করবে কি না—তার আগে নিজেদের জিজ্ঞেস করি: আমি কি আজ ডাস্টবিন ব্যবহার করেছি? লাইট–সিগন্যালে থেমেছি? লাইনে দাঁড়িয়েছি? শব্দ কম রেখেছি? নিয়ম–শৃঙ্খলা মানতে আমাদের কোনো ধর্ম, ভাষা, পাসপোর্ট লাগে না—লাগে শুধু ইচ্ছা।
এখনই শুরু করুন—আজকের ছোট শিষ্টাচার আগামীকের বড় সুযোগ বানায়: স্বাস্থ্যবান শহর, নিরাপদ রাস্তা, পরিষ্কার ইমেজ, ভালো চাকরি–শিক্ষার দরজা—সবকিছুর চাবি এই সাধারণ “সিভিক সেন্স”-এ।